লিখছেন, অরূপ বৈশ্য
কোরাস গঠিত হয় ১৯৮৬ সালে। সালটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আঞ্চলিক, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এই সালের আগে পিছের সময়কালকে চিহ্নিত করা যায়। সংক্ষেপে এই সময়টাকে চিহ্নিত করা যায় এভাবে - আন্তর্জাতিক স্তরে নিওলিবারেলিজম চালু ও বিশ্বব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের ভাঁটা, ভারতবর্ষে 'কল্যাণকামী' রাষ্ট্র থেকে নিওলিবারেলিজমের দিকে ঝুঁকে পড়া, প্রতিষ্ঠিত বামেদের দক্ষিণপন্থী ঝোঁক, অসম আন্দোলনের উগ্রজাতীয়তাবাদী শক্তির ক্ষমতা দখল, বরাকে মাতৃভাষার অধিকারে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা ও তার স্তিমিত হওয়া। এই লক্ষণগুলো দেখায় যে প্রগতিশীল ধারা ক্ষয় প্রাপ্ত হচ্ছে, কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।
নক্সালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহ ছিল তার আগের প্রগতিশীল আবেগের জন্মদাতা যখন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে প্রতিভাবান ছাত্ররা জীবন বাজী রেখে বেড়িয়ে পড়ছে সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে, এমনই ছিল তার আবেগ, বিপ্লবী আবেগ। তাদের তাগিদ ছিল জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার, লক্ষ্য ছিল সমাজ পরিবর্তন। ১৯৮৬-এর সময়টা হচ্ছে সমাজ ও সমষ্টিগত পরিস্থিতির সময় ও আবেগের পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে সমাজবিজ্ঞান ও শিল্পের বৌদ্ধিক চর্চায় কিন্তু উদ্দেশ্যে হিসাবে সবাই সবকালে, সেটা ধর্ম, অর্থনীতি, রাজনীতি, দর্শন, নাটক সব ক্ষেত্রে, সামাজিক কল্যাণকে প্রাধাণ্যের অবস্থায় রেখছেন, বিচারধারা ভুল বা শুদ্ধ যা'ই হোক।
কিন্তু নাটক এমন একটি মাধ্যম যাতে ব্যক্তির অবদান থাকে, কিন্তু মাধ্যমটা মূর্ত হয়ে উঠে সমষ্ঠিগত প্রয়াসে, আর কার্যকরী ও জীবন্ত হয়ে উঠে দর্শকের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে। অর্থাৎ নাটকের জীবন্ত হয়ে উঠা হচ্ছে দর্শকের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে যোগসূত্র স্থাপনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে বাস্তবের চর্চা ও বাস্তবকে বোঝা। আবার বাস্তবের অবয়বটি হচ্ছে এক জটিল বহমান তাত্বিক নির্মাণ।
প্রসেনিয়াম ধারার মূলে ছিল এমনই একটি তাত্বিক নির্মাণ। কিন্তু এই নির্মাণের খামতিটি লুকিয়ে ছিল ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের সাথে ইউরোপীয় তৎকালীন নির্দ্দিষ্ট বাস্তবতা থেকে উৎসারিত ভাবধারার এক সংমিশ্রণ, নির্মাণ হিসাবে সংমিশ্রণ -- ভারতীয় বাস্তবতা ও বাস্তবতা থেকে উৎসারিত ভারতীয় আবেগ বোঝার ক্ষেত্রে খুব দুর্বল হাতিয়ার, আর দুর্বল হাতিয়ার ভারতীয় দর্শকের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের ক্ষেত্রে অনুপযোগী, ফর্মটি ছিল তার অনুসারি। যেহেতু কন্টেন্ট ও ফর্মে ছিল ইউরোপীয় বাস্তবতার প্রতিফলন, তাই কন্টেন্ট ও ফর্ম মিলে সামগ্রিকভাবে যাকে বলা হয় প্রসেনিয়াম থিয়েটার সেটা সেই দর্শকের একাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেলো যারা আধুনিক পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় উচ্চ ও মধ্যশ্রেণি হয়ে উঠেছেন।
বাদল সরকার এই তাত্বিক নির্মাণকে এক উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। তাঁর মত ছিল ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা একটি আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ, আর নাটক হলো বিনোদনের মাধ্যমে আন্দোলন। নাটক একটি আন্দোলন কারণ নাটক সরাসরি দর্শকের সাথে কথা বলে, আর এই কথা বলতে গেলে বাস্তবতা ও আবেগের গভীর চর্চা দরকার। নক্সালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহও দেখিয়ে দিয়েছিলো সেই বাস্তবতাকে সেই সময়ের ভারতীয় আবেগের নাড়ি ধরে টান দিয়ে এবং ভারতীয় সমাজের আধা-উপনিবেশিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক চরিত্রকে উন্মুক্ত করে। বাস্তবতার এই কন্টেন্টের উপর দাঁড়িয়ে যে ফর্মটি তিনি রচনা করেছিলেন, সেই কন্টেন্ট ও ফর্ম মিলে যে সামগ্রিক অবয়ব তার নামই তৃতীয় ধারার নাটক।
বহুদিন যাবৎ এই চিন্তা বজায় থাকলো যে দু'টি ধারাই পাশাপাশি চলতে পারে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, দু'টি ধারার মধ্যেই এই বাস্তবতা নিহিত ছিল যে ভারতীয় সমাজে আধুনিক মধ্যশ্রেণি যেমনি আছে, তেমনি কৃষক প্রাধাণ্যে কিছু শ্রমিকশ্রেণিও আছে। দু'টি ধারা পাশাপাশি চলার অর্থ, প্রসেনিয়াম মধ্যশ্রেণিকে বিনোদন দেবে, আর তৃতীয় ধারা শ্রমিক কৃষকের মধ্যে গ্রামে গঞ্জে যাবে ও মধ্যশ্রেণিকে আকৃষ্ট করবে এই নাটকের বিষয়বস্তুতে। নাটক যখনই শুধু উচ্চোকোটির বিনোদন হয়ে পড়ে, তখনই তার প্রাণশক্তি শুকিয়ে যায়, কারণ নাটক জীবন্ত হয়ে উঠে সামগ্রিক দর্শকের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে। মধ্যশ্রেণি যখনই বিনোদনের আরও ভালো মাধ্যম খুঁজে পায় যার স্থান-কালকে সে তার মতো করে নির্বাচন করতে পারে, তখনই সে নাটক থেকে দূরে সরে যায়। প্রসেনিয়াম দর্শককে আকৃষ্ট করার তার প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে। তৃতীয় ধারার নাটক তার প্রাণশক্তি নিয়ে আরও বেশ কিছুকাল টিঁকে থাকে, এই টিঁকে থাকার সূত্র ধরে ১৯৮৬ সালে কোরাসের জন্ম ও তারপর দীর্ঘ যাত্রা।
কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন এখন আবার নাটকে দর্শক হতে শুরু করেছে। তাদের এই আত্মতৃপ্তির পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। একটি সংকটকালে অন্য বিকল্প বিনোদনের মাধ্যম সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কিছু দর্শক একবার মুখ ফিরিয়ে দেখতেই পারেন। কিন্তু পুরোনো চর্চার চর্বিতচর্বন দেখে অতিসত্বর আবারও মুখ ঘুরিয়ে নেবেন না সেটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
নাটক ও দর্শকের মেলবন্ধন ঘটাতে হলে বর্তমান নতুন বাস্তব পরিস্থিতির চর্চা ও অনুধাবন করতে হবে ও এই বাস্তবতা থকে উৎসারিত জনগণের আবেগকে বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী নতুন ফর্ম নির্ধারণ করতে হবে। নাটক বিনোদনের মাধ্যমে আন্দোলন এবং সেজন্যই নাটক সামাজিক চর্চা। নাটক আদিমকাল থেকেই সমাজের অঙ্গ।
যে কোনো শিল্পেই দর্শকের সাথে প্রথম যোগসূত্র স্থাপন করে তার হৃদয়ের সাথে, সেই হৃদয় থেকে যাত্রা করে শিল্পের বিষয়বস্তু তার মস্তিষ্কের চিন্তাস্রোতে তরঙ্গ সৃষ্টি করে।
নাটককে দর্শকের সাথে সরাসরি কথা বলতে হয়, সুতরাং নাট্যধারা যদি বাস্তব ও আবেগকে বুঝতে না পারে, সেটা একটি ধারা হিসাবে পুস্তকে স্থান পেতে পারে, মুষ্টিমেয় কিছু লোক ছাড়া সমাজ এনিয়ে মাথা ঘামায় না।
আমার মতে ভারতীয় প্রেক্ষিতে বাদল সরকারের তৃতীয় ধারা ছিল প্রসেনিয়ামের একটি উত্তরণ। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নাট্যশিল্প আরেকটি উত্তরণের অপেক্ষায়। অন্যথায় শহরের ভবনগুলিতে কিছু মঞ্চসফল নাটক ও গ্রামে কিছু পরিক্রমার আত্মতুষ্টি নিয়ে চললে নাটকের কার্যকারিতার অপমৃত্যুও ঘটতে পারে।
মনে রাখতে হবে নাটক আদিম যুগের সামাজিক শিল্প এবং তাকে এগিয়ে যেতে হবে আধুনিক ভবিষ্যত সমাজের সামাজিক শিল্প হয়ে উঠার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। নাটককে সামাজিক শিল্পমাধ্যম করে তোলার ভাবনা নাট্যকর্মী ও নাট্যবোদ্ধাদেরই ভাবতে হবে।
সবশেষে, এতোটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, কোরাস তার সমস্ত দোষত্রুটি ও দুর্বলতা নিয়ে (যা না থাকলে উত্তম পরিস্থিতি হতো) এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। ক্যারিয়ারের হাতছানিকে উপেক্ষা করে এই প্রক্রিয়ায় আত্মনিয়োগ করাই সময়ের দাবি।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your Valuable comment