লেখকঃ- Kamal Chakraborty
“ শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে” -- এটাই হয়তো এই বছরের শেষ পোষ্ট।
এই লকডাউন পিরিয়ডে অসহায় নিরক্ষর গরিব মানুষদের কীভাবে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেওয়া যায় তার- ই এক প্রচেষ্টা। শিলচর সহ বরাকভ্যালীতে এতো সংগঠন থাকা সত্ত্বেও কেন ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা ব্যক্তিদের মুক্তির জন্য সুপ্রিমকোর্টের রায়ের সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে তৎপর হলো না, ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি!
এই কাজ করতে করতে মুহূর্তগুলো কেটেছে বেশকিছু অপিরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে। কাছাড় এসপি বর্ডার, দুই জন পুলিশ অফিসার সহ বেশকয়েক পুলিশ কর্মী। এসপি অফিসে একটি ক্যান্টিনও আছে। সেখানে চা বিস্কুট ঘুগনি পাওয়া যায়। একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টির মধ্যে খিচুড়িও রান্না হলো। প্রথমদিকে সবার একই প্রশ্ন, আপনি এখানে কেন আসেন ! পরবর্তীতে আর কিছু বলতো না, বরং সাহায্য করত এগিয়ে আসতো। দিনে কয়েকবার এসপি অফিস থেকে শিলচরের জেলে যেতে যেতে একটি পরিচয় হয়ে যায় জেল সুপার থেকে শুরু করে জেলের পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে। শিলচরের এডিশনাল এসপি বর্ডার সহ আরো কয়েকজন পুলিশ অফিসার, পুলিশ কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিঃস্বার্থ সহযোগিতার জন্যই এই কাজগুলো সম্ভব হয়েছে। প্রত্যেকেই ভীষন নম্র ও ভদ্র। বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে দিতেন সবাই মিলে। হাইলাকান্দির এসপি বর্ডার সহ পুলিশকর্মীদের সাহায্যও ভুলবার মতো নয়। হাফলঙ এসপি বর্ডার সহ অন্যান্য পুলিশ কর্মীদের কাজের তো ভূয়সী প্রশংসা করতে হয়। এই লকডাউন পিরিয়ডে কোর্ট বন্ধ থাকায় এফিডেভিটের জন্য স্টাম্প পেপার কোর্ট ফি ইত্যাদি পাওয়া খুব দুষ্কর ছিল। তবুও এর-ই মধ্যে শিলচরের আইনজীবী আব্দুল হাইAbdul Hai মহাশয় ভীষনভাবে সাহায্য করেছেন। তার এই অবদানের জন্য কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি উধারবন্দ , লক্ষীপুর থানার পুলিশ কর্মীদেরও ,যারা এই লকডাউন পিরিয়ডেও জামিনদার সহ অন্যান্যদের বারবার শিলচর আসা যাওয়ার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আসলে সবাই মিলে অজান্তেই এবং পরিকল্পনা বিহীন একটা” টিম ওয়ার্ক” তৈরি হয়েছিল যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি দেওয়া যায় অসহায় মানুষদের। “নেলেক”ও “সক্ষম” – এর কর্মকর্তারাও ভীষণ ভাবে সাহায্য করেছেন বেশকিছু অসহায় মানুষদের। মুক্তি পাওয়ার পর রেশন দেওয়া, আর্থিক সহায়তা সহ ডিটেইনিদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। তাদের প্রতি রইল আন্তরিক শুভেচ্ছা। সমস্ত জামিনদারদের প্রতি রইল আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। চলতে চলতেই উদয় হলো করিমগঞ্জের কিছু বন্ধু যারা ১৯৮৯ সালে মাধ্যমিক দিয়েছিল, তাদের কিছু বন্ধু বান্ধব মিলে আর্থিক সহায়তা করেছে ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়া কিছু ব্যক্তিদের । করিমগঞ্জের বন্ধুরা মিলে আজও কিছু আর্থিক সাহায্য করলেন সিদ্দেক আলি কে। তাদের আন্তরিক শুভেচ্ছা।
সিদ্দেক আলি। বয়স ৬৯ বছর। দিন মজুরি। বাবার নাম – প্রয়াত মসদ্দার আলি। আগে থাকতেন হোজাইতে। ১৯৬৫ সালে কাটলিছড়ায় থাকতেন। ভোটার তালিকায় নিজের নামও আছে। পরবর্তীতে ১৯৯৭, ২০০৫ এবং ২০১৬ সালেও ভোটার তালিকায় নাম আছে। কর্মসূত্রে চলে আসেন হাতিখালি( শিব মন্দিরের পাশে)। জেলা – ডিমাহাসাও। একদিন তাঁর ভাড়া বাড়ির দেওয়ালে নোটিশ সেঁটে পুলিশ চলে যান। নিরক্ষর সিদ্দেক ও তাঁর স্ত্রী রাবেয়া বেগম-বুঝতেই পারেনি নোটিশের গুরুত্ব!! ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের ২০ তারিখে হাফলঙ ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল থেকে সিদ্দেক কে বিদেশি ঘোষণা করা হয় একতরফা রায়ে, কেন না তাঁরা কেস যে লড়তে হয় সেটাই জানতেন না। এক- ই সালের সালের পাঁচ জুন হাতিখালি থানা থেকে পুলিশ এসে তুলে নিয়ে সোজা শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
মেয়ে আস্মা বেগম ক্লাস ফোরে এবং ছেলে ইকবাল হোসেন ক্লাস এখন নাইনে পড়ছে হাতিখালি'র একটি সরকারি স্কুলে। ডিটেনশন ক্যাম্পে দু’বছর অতিক্রান্ত। আজ বৃহস্পতিবার (১১.০৬.২০২০) ছাড়া পেলেন সিদ্দেক আলি। স্ত্রী রাবেয়া বেগম- এর সাথেই ফোনে যোগাযোগ। নিজে কষ্ট করেই সংসার চালান। রাবেয়ার আবার হার্টের রোগ! আজ নিজেই এসেছেন স্বামী কে নিয়ে যেতে। ভালো থাকুক সিদ্দেক আলি ও তাঁর পরিবার।
হাফলং,ধলাই, কাটিগড়া ও হাইলাকান্দি নিয়ে আর মাত্র চারজন শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে আছে। তাদের মুক্তি হবে এক বছর পর।
ডিটেনশন ক্যাম্পে যাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাদের কাগজপত্র দেখলে বোঝাই যায় এরমধ্যে ৯৫ শতাংশ ব্যক্তিরাই ভারতীয়। ছলে বলে কৌশলে ভারতীয়দের ধরে ধরে ‘বিদেশি’বানানো হচ্ছে। কোথাও আইনজীবীদের গাফিলতি আবার কোথাও একতরফা রায়ের ফলে তাদের এই নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হয়েছিল বা হচ্ছে !
ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্ত হওয়া মানুষদের জন্য আসামের জনবিন্যাস, আসামের অর্থনীতি - সমাজনীতির ওপর কোনো বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় না। মিছেমিছি গরিব অসহায় মানুষের ওপর অত্যাচার আর না-ই বা করলো আমাদের সরকার।
গোয়ালপাড়ায় পাঁচ হাজার মানুষের জন্য যে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে, সেটাকে না হয় করোনা আক্রান্ত মানুষের জন্য হাসপাতালই তৈরি হোক। সেখানে কম করেও দশ হাজার মানুষের চিকিৎসা হবে। কেন্দ্রীয় সরকার সহ আসাম সরকার যদি সেটাকে হাসপাতালে রূপান্তরিত করে, তাহলে শুধুমাত্র আসামের জনগণ নয় , সারা ভারতবাসী এই সরকারকে সাধুবাদ জানাবে।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your Valuable comment