লেখকঃ- মারজান আহমদ চৌধুরী ফুলতলী
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ
الْمُؤْمِنُ الْقَوِيُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِي كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ فَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَذَا وَكَذَا وَلَكِنْ قُلْ قَدَّرَ اللَّهُ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَان
"সবল মুমিন আল্লাহর কাছে দুর্বল মুমিন থেকে উত্তম ও প্রিয়, যদিও উভয়ের মাঝে কল্যাণ রয়েছে। চেষ্টা করে যাও সে বিষয়ের জন্য, যা তোমাকে কল্যাণ দেবে এবং আল্লাহর সাহায্য কামনা করো। হাল ছেড়ে দিওনা। যদি কোনো সমস্যা/বিপদ-আপদ আসে, তাহলে এটি বলো না যে, যদি আমি এরূপ এরূপ করতাম (তাহলে এরকম না হয়ে ওরকম হতো)। বরং বলো, এসব আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, তিনি যা চান তা-ই করেন। কেননা "যদি" শব্দটি শয়তানি কাজের দরজা খুলে দেয়।" [সহীহ মুসলিম; কিতাবুল ক্বাদর, সুনান ইবনে মাজাহ, কিতাবুস সুন্নাহ]
উপরিউক্ত হাদিসে আল্লাহর নবী ﷺ উম্মতের জন্য ৫ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন, যা অনুসরণ করে আমরা জীবন চলার পথে প্রয়োজনীয় সব সিদ্ধান্ত (Decision) এবং ব্যবস্থাপনা (Management) গ্রহণ করতে পারি। অমূল্য এ হাদিসটি একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
হাদিসের প্রথম নির্দেশনা হচ্ছে, "সবল মুমিন আল্লাহর কাছে দুর্বল মুমিন থেকে উত্তম ও প্রিয়, যদিও উভয়ের মাঝেই কল্যাণ রয়েছে।" এখানে সবল বলতে কেবল দৈহিকভাবে বলশালী হওয়া উদ্দেশ্য নয়। হতে পারে কেউ শারীরিকভাবে শক্তিশালী, কেউ মানসিকভাবে দৃঢ়, আবার কেউ জ্ঞান-বুদ্ধির দিক থেকে অধিক বিচক্ষণ। আল্লাহ একেকজনকে একেক ধরণের নিয়ামত দেন। প্রয়োজন কেবল নিজের Strong point তথা শক্তিশালী দিকটি যথাযথভাবে শনাক্ত করা এবং এটি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ রা. শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং সামরিক দিক থেকে সুকৌশলী ছিলেন। অপরদিকে হাসসান ইবনু সাবিত রা. ছিলেন কাব্য-সাহিত্যে পারদর্শী। তাঁরা উভয়েই নিজ নিজ সক্ষমতাকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন। তাই খালিদ মাঠ কাঁপিয়েছেন তরবারি হাতে, হাসসান কাঁপিয়েছেন কলম হাতে।
আমাদেরকে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে ভেবে দেখা উচিৎ যে, আমি কি সত্যিই এ পথে যেতে চাই? এ পথে যাওয়ার ইচ্ছা এবং সামর্থ কি আমার মধ্যে আছে? নইলে ভূতের বেগারখেটে কোনো লাভ নেই। হ্যাঁ, কিছু মানুষ আছেন, যারা অনেক ক্ষেত্রে দুর্বল। তবে কল্যাণ তাঁদের মধ্যেও রয়েছে। এ কল্যাণটি ঈমানের কল্যাণ।
দ্বিতীয় নির্দেশনা হচ্ছে, "চেষ্টা করে যাও সে বিষয়ের জন্য, যা তোমাকে কল্যাণ দেবে।" এখানে কল্যাণ দ্বারা দুনিয়া আখেরাত উভয়ের কল্যাণ উদ্দেশ্য।
যখনই আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারব যে, আমার মধ্যে এই নির্দিষ্ট গুণ রয়েছে বা এই কাজে আমার জন্য কল্যাণ রয়েছে, আমার উচিৎ তখন থেকেই সে কাজে নিজেকে সমর্পিত করা। আন্তরিক ইচ্ছা এবং অবিরাম চেষ্টা ব্যতীত দুনিয়াতেও কিছু হাসিল হয় না, আখেরাতের জন্যও কিছু প্রস্তুত করা যায় না। আল্লাহ বলেছেনঃ
وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَىٰ
"এবং মানুষ কেবল তা-ই পায়, যার জন্য সে চেষ্টা করে।" [সুরা নাজম : ৩৯]
হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে আল্লাহর দয়ায় চেষ্টা না করেই সফলতা ধরা দিয়ে দেয়। তবে সেটি সাধারণ নিয়ম নয়।
তৃতীয় নির্দেশনা হচ্ছে, "আল্লাহর সাহায্য কামনা করো।" আমি নির্দিষ্ট কাজে যতই সক্ষম হই না কেন, যত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম-ই করি না কেন, শেষপর্যন্ত আল্লাহর সাহায্যই আমাকে আমার কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাইয়ে দেয়। সুতরাং আমি পরিশ্রম করব, কিন্তু ভরসা আমার পরিশ্রমের ওপর নয়; ভরসা আল্লাহর ওপর।
চতুর্থ নির্দেশনা হচ্ছে, "হাল ছেড়ে দিওনা।" সবল এবং দুর্বলের মধ্যে পার্থক্য এই জায়গায়। সবল হতাশ হলেও হাল ছাড়ে না, দুর্বল সামান্য দুশ্চিন্তায় মাঠ ছেড়ে পলায়ন করে। এ নির্দেশনা শুধু আমাদের জন্য নয়; বরং নবী-রাসূলদের জন্যও প্রযোজ্য ছিল। খোদ সায়্যিদুল মুরসালিন মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জীবনে বহুবার শূন্যহাতে ঘরে ফিরতে হয়েছে, বহু বিরোধিতা বহু আঘাত সহ্য করতে হয়েছে, বহু বাধাবিপত্তি পেরুতে হয়েছে- কিন্তু ইসলামের নবী এক মূহুর্তের জন্যও হাল ছাড়েননি। ছেড়ে দিলে আজ পৃথিবীতে ইসলাম বলে কিছু থাকত না।
মোটকথা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর "একবার আগে-একবার পিছে" করা দুর্বল ঈমানের লক্ষণ।
পঞ্চম নির্দেশনা হচ্ছে, ব্যর্থতায় নিজের ওপর যদি-কিন্তুর বোঝা না চাপিয়ে তাকদীরের ওপর আস্থা রাখা।
আমি আমার পছন্দ ও সামর্থ অনুযায়ী একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম, এটি হাসিল করার জন্য খুব চেষ্টা করলাম, আল্লাহর সাহায্য কামনা করলাম, সব বাধাবিপত্তির মাঝেও নিজেকে অবিচল রাখলাম- তবুও সফলতার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি না। তাই আন্তরিক ইচ্ছা, অবিরাম প্রচেষ্টার পরও যদি ব্যর্থতা আসে, তাহলে এর জন্য অতীতের কবর খুঁড়ে নিজেকে দোষারোপ করার কোনো মানে নেই। অতীত থেকে শিক্ষা নেয়া উচিৎ, কিন্তু অতীতকে নিয়ে বসে থাকা বা হাহাকার করা বোকামি। "যদি এটি না করে ওটি করতাম, যদি এমন না হয়ে তেমন হতো"- এ ধরণের কথা মূলত ঈমানের দৈন্যতা এবং শয়তানের চোর-দরজা। বস্তুত, আল্লাহ আমার ভাগ্য নির্ধারণ করেন এবং তিনি যা ভালো মনে করেন, সেটিই বাস্তবায়িত হয়।
মুমিনের উচিৎ, এই ৫ দফা নির্দেশনা (নিজের সবলতাকে শনাক্ত করা, অবিরাম চেষ্টা করা, আল্লাহর সাহায্য চাওয়া, হাল না ছাড়া এবং ব্যর্থতাকে মেনে নেয়া) অনুসরণ করে জীবনে সিদ্ধান্ত এবং ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করা। ইনশাআল্লাহ এতে আমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।
No comments:
Post a Comment
Thanks for your Valuable comment